অক্টোবরে শেষ দেখার আশায় বিএনপি
ঢাকাকেন্দ্রিক লাগাতার কর্মসূচির মধ্য দিয়ে সরকারের পতন ঘটাতে চায় বিএনপি। শেষ ধাপের এই কর্মসূচির দিনক্ষণ চূড়ান্ত না হলেও আগামী অক্টোবর মাস সামনে রেখে পরিকল্পনা সাজাচ্ছে দলটি। বিএনপি ও যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গী দলগুলোর নেতারা জানিয়েছেন, আগামী জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সে অনুযায়ী নভেম্বরের শুরুতেই তফসিল ঘোষণা হওয়ার কথা। তাই যা করার, অক্টোবরের মধ্যেই করতে হবে। গত সোমবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
চূড়ান্ত আন্দোলন অক্টোবরে করলেও এর আগে মাঠ গরম রাখতে ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে যুগপৎ আন্দোলনের বেশ কিছু কর্মসূচি পালন করবে বিরোধী দলগুলো। এর অংশ হিসেবে আগামী শুক্রবার থেকে আবারও যুগপৎ আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি মাঠে গড়াতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন নেতারা।
চলমান এক দফা আন্দোলন ‘চূড়ান্ত’ পর্যায়ে এসেছে দাবি করে দলমত-নির্বিশেষে সবাইকে এতে শরিক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক আলোচনা সভায় তিনি বলেন, ‘আন্দোলন এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে এসেছে। এবারের আন্দোলন কিছু নতুন মাত্রা পেয়েছে। এই সরকারকে সরিয়ে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার বিষয়ে মানুষ আজকে এক হয়েছে। বড় দল, ছোট দল, মাঝারি দল—এটা বড় কথা নয়। বড় কথা হচ্ছে, আমাদের দেশ ও মানুষ বিপদগ্রস্ত।’ এই অবস্থায় সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাজপথে নামার আহ্বান জানান তিনি।
চূড়ান্ত আন্দোলনের কর্মসূচি কবে আসছে জানতে বিএনপি ও শরিক দলগুলোর বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা হয়েছে আজকের পত্রিকার। তাঁরা বলছেন, নভেম্বরে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে ধরে নিয়ে অক্টোবরেই যা করার করতে হবে, এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। দলগুলো এ বিষয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনার পাশাপাশি যৌথভাবেও আলোচনায় বসছে।
নেতারা এ-ও বলেন, এইচএসসি পরীক্ষার কারণে এখন চাইলেও শেষ ধাপের বড় কর্মসূচি পালনের সুযোগ নেই। এই অবস্থায় আগামী ২০ সেপ্টেম্বর থেকেই ওই ধাপ শুরুর সম্ভাবনা রয়েছে। শেষ ধাপের কর্মসূচি হবে ঢাকাকেন্দ্রিক এবং তা হবে লাগাতার। সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত এই কর্মসূচি পালন অব্যাহত থাকবে। এ সময় পরিস্থিতি ও প্রয়োজন অনুযায়ী কর্মসূচি ঠিক করা হবে।
কোন ধরনের কর্মসূচি আসতে পারে
শেষ ধাপের আন্দোলনে মহাসমাবেশ, সমাবেশ, ঘেরাও এবং অবস্থান কর্মসূচিতে গুরুত্ব দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন বিরোধী দলগুলোর নেতারা। বিচারালয়ের সামনে অবস্থানের মধ্য দিয়ে শেষ ধাপের আন্দোলন শুরুর পরিকল্পনা রয়েছে তাঁদের। পর্যায়ক্রমে নির্বাচন কমিশন, গণভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সচিবালয়সহ আরও কিছু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সামনেও কর্মসূচি পালন করার চিন্তা রয়েছে। চূড়ান্ত ধাপে এসব প্রতিষ্ঠান ঘেরাওয়ের চিন্তাও আছে।
আছে সংশয়-সন্দেহ
সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে গত ১২ জুলাই থেকে এক দফা আন্দোলনের ঘোষণা দেয় বিএনপি। গত ২৫ ও ২৬ আগস্ট ঢাকাসহ দেশব্যাপী কালো পতাকা গণমিছিলের কর্মসূচি পালিত হয়। এরপর যুগপৎ আন্দোলনের আর নতুন কোনো কর্মসূচির ঘোষণা আসেনি।
এদিকে শুরুতে এক দফা আন্দোলন ঝোড়ো গতি লক্ষ করা গেলেও গত ২৮ জুলাই ঢাকায় মহাসমাবেশ ও ২৯ জুলাই ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচির পর তাতে ছন্দপতন ঘটে। এতে এক দফা আন্দোলন নিয়ে কিছুটা সংশয় দেখা দেয়। আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দেহ-সংশয় এখনো বিরাজমান। খোদ বিএনপিসহ আন্দোলনকারী দলগুলোর নেতারাই এমন সংশয়ের কথা জানান। তাঁদের অনেকে বলছেন, এটা খুবই সত্যি যে ২৮-২৯ জুলাইয়ের আগে আন্দোলন যে পর্যায়ে ছিল, তা এখন নেই। এই অবস্থায় আগামী দিনে কতটুকু কী করা সম্ভব হবে, তা নিয়ে সংশয় থাকা খুব স্বাভাবিক।
এদিকে বিএনপির চাওয়ার স্পষ্টতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন শরিকদের অনেকে। একটি শরিক দলের নেতা বললেন, আন্দোলনের শেষ ধাপে যাওয়ার আগে আগেও সত্যিকার অর্থে বিএনপির চাওয়া এখনো অস্পষ্ট। বিএনপি আসলে কী চাচ্ছে, সেটা পরিষ্কার নয়। এই অবস্থায় কীভাবে কী হবে, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়।
যদিও আরেকটি জোটের নেতা এই সংশয়কে উড়িয়ে দিয়ে বললেন, কোনো সংশয় নেই। সব সংশয়ের অবসান হবে মাঠেই। শেষ ধাপে ১০-১৫ দিনের মধ্যেই আন্দোলনের সফল পরিণতি ঘটবে বলে প্রত্যাশা করছি।
চলছে গ্রেপ্তার, পুরোনো মামলায় গতি
সরকারের পতন এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে এক দফা আন্দোলন যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে, তখন আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বিএনপিকে চোখ রাঙাচ্ছে গ্রেপ্তার ও মামলা। দলটির দপ্তরের দেওয়া তথ্যমতে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে গত প্রায় ১৪ বছরে ১ লাখ ৪১ হাজার ৯৩৪টি মামলায় ৪৯ লাখ ৪০ হাজার ৪৯২ জন নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়েছে। গত এক মাসে বিভিন্ন কর্মসূচি ঘিরে রাজধানীসহ সারা দেশে ৩৩১টি মামলায় আসামি করা হয় ১৩ হাজার ৯৩০ জনকে। এ সময়ে অন্তত দেড় হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়।
দলটির সূত্র বলছে, বর্তমানে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধেই মামলা রয়েছে ৯৩টি। সর্বোচ্চ ৪৫১টি মামলা হয়েছে দলের যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেলের বিরুদ্ধে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যদের মধ্যে খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে ৭টি, জমিরউদ্দিন সরকারের বিরুদ্ধে ৪টি, মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে ৪৮টি, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের বিরুদ্ধে ৩৬টি, নজরুল ইসলাম খানের বিরুদ্ধে ৬টি, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে ৬টি, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর বিরুদ্ধে ৯টি, সেলিমা রহমানের বিরুদ্ধে ৪টি ও সালাহউদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে ৬টি মামলা রয়েছে।
এ ছাড়া যুবদল সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর বিরুদ্ধে ৩১৩টি, যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নীরবের নামে ৩০৫টি, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের বিরুদ্ধে ২৫৪টি, ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলুর বিরুদ্ধে ২০৪টি, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর বিরুদ্ধে ১৮০টি, নির্বাহী কমিটির সদস্য শেখ রবিউল আলম রবির বিরুদ্ধে ১৮৪টি, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক রাজিব আহসানের বিরুদ্ধে ১৪৭টি, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লা আমানের বিরুদ্ধে ১০৬টি, নির্বাহী কমিটির সদস্য আকরামুল হাসানের বিরুদ্ধে ১০৩টি মামলা রয়েছে। এখনো প্রতিদিনই এই বহরে আরও নতুন নতুন মামলা ও আসামি যুক্ত হচ্ছে। আন্দোলনের ভরা মৌসুমে এসব মামলার বোঝায় বেশ নাজেহাল হয়ে পড়েছেন দলটির নেতা-কর্মীরা।
গতকাল নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, পুলিশ ও আদালত আইনের শাসনের বদলে শেখ হাসিনার চোখরাঙানিকেই আমলে নিচ্ছে। আওয়ামী সরকারের ক্ষমতায় থাকার লালসা পূরণের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করছেন আদালতের বিচারকেরা। সে জন্য তাঁরা অত্যন্ত আন্তরিকতা সহকারে জোরেশোরে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলায় সাজা দেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। বিরোধী দল নিধনে বাংলাদেশের আদালত আরেকটি ‘আয়নাঘরে’ পরিণত হয়েছে।