২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে যেভাবে গ্রেপ্তার করা হয়
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়। বঙ্গবন্ধু আগেই পাকিস্তানি সামরিক জান্তার এই আক্রমণ সম্বন্ধে ধারণা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বাঙালির মুক্তিসংগ্রামকে নিশ্চিহ্ন ও নেতৃত্বহীন করতে ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে মেজর জেনারেল খাদিম ও মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে একটি পরিকল্পনা তৈরি করেন। আলোচনাকালেই বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেপ্তারের জন্য তালিকা প্রণয়ন করা হয়।
এই পরিকল্পনা অনুমোদন করে প্রেসিডেন্ট গোপনে ঢাকা ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। উইং কমান্ডার এ কে খন্দকার তাঁর অফিস থেকে প্রেসিডেন্টের বিমানে ওঠার দৃশ্য দেখে ফেলেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে এই সংবাদ বঙ্গবন্ধুকে জানিয়ে দেন।
২৫ মার্চ সন্ধ্যা ৭টার আগেই একে একে আওয়ামী লীগ ও এর অন্যান্য অঙ্গ দলের নেতারা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে তাঁর নির্দেশ নিয়ে চলে যান। সন্ধ্যায় আসেন ছাত্র নেতারা। রাত ৮টায় এ এইচ এম কামারুজ্জামান, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম পুনরায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন। বঙ্গবন্ধু নিজে আত্মগোপনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
একটি দেশের নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা পালিয়ে যেতে পারেন না। সে রাতে এত উত্তেজনার মাঝেও শেখ মুজিব শান্তভাবে পাইপ টানছিলেন। তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে তাঁর যা কিছু করণীয়, সবই তিনি করেছেন। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত তিনি বাঙালি জনগণকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করেছেন। শুধু গ্রেপ্তার কেন, যেকোনো পরিস্থিতির জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন।
রাতের মধ্যভাগে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ঘটনার দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। অনবরত বেজে চলেছে টেলিফোন। চারদিকে গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে এবং দূর থেকে চিৎকার ভেসে আসছে। বিশ্ববিদ্যালয় আক্রমণ করা সম্পর্কে তখনো তিনি কিছু জানতেন না, তবে ইপিআরের ব্যারাক ও রাজারবাগ পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স আক্রান্ত হওয়া সম্পর্কে তিনি অবহিত ছিলেন।
এর একমাত্র অর্থ হলো পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালি-সমর্থক সব সামরিক অবস্থান নিশ্চিহ্ন করতে চায়। তিনি কেন্দ্রীয় টেলিগ্রাফ দপ্তরের এক ঘনিষ্ঠজনের কাছে সর্বত্র প্রচারের জন্য তখন স্বাধীনতার সেই ঐতিহাসিক বার্তাটি পড়ে শোনান। বার্তাটি ছিল এ রকম: মধ্যরাতে পাকিস্তানি বাহিনী রাজারবাগ পুলিশ লাইনস ও পিলখানার ইপিআর হেডকোয়ার্টার্স আক্রমণ করেছে। এদের প্রতিহত করতে শক্তি সঞ্চয় করুন এবং প্রস্তুত হোন স্বাধীনতাযুদ্ধের জন্য।
বঙ্গবন্ধুর গ্রেপ্তারপর্বে ছিল উত্তেজনাপূর্ণ মুহূর্ত ও নাটকীয়তা। এক অতীব গুরুতর দায়িত্ব পেয়েছিলেন পাকিস্তানি মেজর বিলাল। রাত দেড়টার সময় তিনি এটা সমাধা করতে চেয়েছিলেন। তাঁর অধীনে ছিল একটি ট্যাংক, একটি এপিসি এবং কয়েকটি ট্রাকবোঝাই সৈনিক।
তিনি তাঁদের নিয়ে যাচ্ছিলেন ধানমন্ডির দিকে। রাস্তায় অনেক ব্যারিকেড ও বাধা অতিক্রম করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বাড়ির সামনে এসে তাঁরা সবাই থামলেন। বাড়িটি তাক করে প্রায় সব সৈনিক মিলে কিছুক্ষণ গুলি চালাল।
কয়েকটি গুলি এসে পড়ল ছাদে এবং ওপরতলার জানালা ভেদ করে ঘরে। প্রায় এক শ সৈন্য বাড়িটি ঘিরে রেখেছিল এবং এমন অসম শক্তি-সমাবেশ প্রমাণ করে, সেনাবাহিনী মনে করেছিল বাড়িটিকে দুর্গ করে তোলা হয়েছে। গোটা বাড়ি যখন ঘিরে ফেলা হলো, তখনো সৈন্যরা আকাশে গুলি ছুড়ছিল। ভাবতে অবাক লাগে, নিরস্ত্র রাজনৈতিক এক নেতার বাড়ি এরূপ সশস্ত্র সেনাবাহিনীর লোকেরা ঘেরাও করতে পারে।
যদিও সন্ধ্যা থেকে শেখ মুজিব ছিলেন শান্ত, গোলাগুলি এবং অতর্কিত আক্রমণের জন্য এবার তিনি রেগে উঠলেন। অরক্ষিত ছোট এক ভবনের ওপর এমনি ব্যাপক হামলা এবং এভাবে গুলিবর্ষণের ঘটনায় তিনি প্রকৃত অর্থেই ক্রোধান্বিত হলেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ব্যালকনিতে বের হয়ে এসে বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি তৈরি। তোমাদের গুলি ছোড়ার কোনো দরকার নেই।’ অফিসারটি এবার উঠোনে এগিয়ে এসে মুজিবকে জানালেন, তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একটি তামাটে ড্রেসিং গাউন ও পায়জামা পরেছিলেন। ক্যাপ্টেন নিরুত্তাপ কণ্ঠে জানালেন, ‘আপনাকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে স্যার।’ এরপর সবাই মিলে রওনা হলেন।
লক্ষণীয়, এরূপ ভয়াবহ ও ভীতিকর পরিস্থিতিতেও বঙ্গবন্ধু অকুতোভয় ছিলেন। তাঁকে একটুও বিচলিত হতে দেখা যায়নি। জেনারেল টিক্কা খানের এডিসি মেজর (অব.) এস জি জিলানির ভাষ্যমতে, ‘গ্রেপ্তারের পর শেখ মুজিবকে রাখা হয়েছিল ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। তিনি ছিলেন অতীব গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা বন্দী।
পাকিস্তানি বাহিনীর ভয় ছিল, হয়তো কোনো বিদেশি রাষ্ট্র, বিশেষভাবে ভারত তাঁকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করার চেষ্টা নিতে পারে। এ জন্য তাঁর অবস্থান গোপন রাখা হয়েছিল এবং এক জায়গায় তাঁকে রাখা হতো না। তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানোর ব্যবস্থা দুইবার বাতিল করা হয়েছিল এই ভয়ে যে খবরটা ভারত জানতে পারলে মধ্য আকাশে বিমানকে ধাওয়া করতে পারে।
বাড়ি থেকে তুলে মুজিবকে নেওয়া হয়েছিল নির্মীয়মাণ জাতীয় সংসদ ভবনে। নিয়ে যাওয়ার এক ঘণ্টা পর বঙ্গবন্ধুর বাসায় আবার আর্মির আরেকটি ট্রাক আসে। এবারকার সৈনিকদের দায়িত্ব ছিল ভিন্নতর। তারা এসেছে বাড়িটি ধ্বংস করতে। তারা তাদের অর্পিত দায়িত্ব দখলদার বাহিনীর মতোই সমাধা করে। বঙ্গবন্ধুর বাড়ি যখন সেনাবাহিনীর লোকেরা আক্রমণ করে, তখন সেখানে প্রাণের একমাত্র লক্ষণ ছিল বড় একটি ধূসর বিড়াল, যেটি বের হয়ে এসে মায়াবী নজরে সবার দিকে তাকিয়ে ছিল, ধুলো খুঁটে বেড়ানো তিনটি মুরগি এবং বাড়ির পেছন দিকের বিভিন্ন ধরনের খাঁচায় এক ডজন কবুতর দৃষ্টিগোচর হয়। বঙ্গবন্ধুর বাসভবনজুড়ে ছিল পরিত্যক্ত এক পোড়ো ভাব।
জুলাই মাসের শেষ দিকে ‘কায়হান ইন্টারন্যাশনাল’ পত্রিকার আমির তাহেরি ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধুর বাড়িটি পরিদর্শন করেন এবং তখনো এর চেহারা ছিল পোড়োবাড়ির মতো। বেশির ভাগ জানালা ছিল ভাঙা এবং প্রায় প্রতিটি দেয়ালে ছিল বুলেটের ক্ষত। যে সাদামাটা ঘরে মুজিব থাকতেন, সেখানে তাহেরি দেখতে পেয়েছিলেন অখোলা চিঠি, বিয়ে ও অনুষ্ঠানাদির আমন্ত্রণপত্র এবং অবোধগম্য আঁকিবুঁকি ভরা বাংলায় লেখা অনেকগুলো পৃষ্ঠা।
অধিকাংশ চিঠি এসেছিল মধ্য মার্চে এবং শেখ মুজিব সেগুলো খোলার সময়ও সম্ভবত পাননি।বঙ্গবন্ধুকে ২৫ মার্চ গ্রেপ্তারের পর তাঁর ঢাকার বাসভবন যেমন তছনছ করা হয়, তেমনি গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর গ্রামের বাড়িটিও রেহাই পায়নি ঘাতকদের ধ্বংসলীলা থেকে।
সাংবাদিক আমির তাহেরি জেনারেল টিক্কা খানকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনি শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করেছিলেন কেন?’টিক্কা খান জবাব দিয়েছিলেন, ‘আমার কো-অর্ডিনেশন অফিসার একটি তিন ব্যান্ড রেডিও নিয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলেছিল, স্যার, শুনুন। শেখ সাহেব স্বাধীনতা ঘোষণা করছেন।’ আমি নিজে রেডিওর এক বিশেষ ফ্রিকোয়েন্সিতে সেই স্বাধীনতার ঘোষণা শুনি।...তাই তাঁকে গ্রেপ্তার করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না।
সাংবাদিক আরও জানতে চাইলেন, ‘তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে শেখ মুজিবও যদি ভারতে যেতেন, তবে সে ক্ষেত্রে আপনি কী করতেন স্যার?’
উত্তরে টিক্কা খান বলেছিলেন, ‘আমি খুব ভালো করে জানি মুজিবের মতো একজন নেতা তাঁর জনগণকে পরিত্যাগ করবেন না। আমি গোটা ঢাকা শহরে তাঁকে খুঁজে বেড়াতাম এবং একটি বাড়িও তল্লাশির বাইরে রাখতাম না। তাজউদ্দীন অথবা তাঁর মতো অন্য নেতাদের গ্রেপ্তারের কোনো অভিপ্রায় আমার ছিল না। সে কারণেই তাঁরা এত সহজে ঢাকা ছেড়ে যেতে পেরেছিলেন।’
জেনারেল টিক্কার এই উক্তি থেকে এটাই প্রতীয়মান হয়, বঙ্গবন্ধুই তাঁদের চিন্তার প্রধান কারণ ছিলেন।
প্রহসনের বিচারে বঙ্গবন্ধুকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েও তা কার্যকর করতে পারেনি পাকিস্তানের বর্বর শাসকগোষ্ঠী। অথচ স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে তাঁকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যা করল একদল অকৃতজ্ঞ বাঙালি। এই কলঙ্ক অমোচনীয়। এই বেদনার ভার বহন করার মতো নয়
প্রকাশিত সোমবার ১৪ আগস্ট ২০২৩