মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ: এক বছরেই দেড় শ কোটি টাকার অনিয়ম
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের ব্যয়ে এক অর্থবছরেই প্রায় দেড় শ কোটি টাকার অনিয়ম হয়েছে। এর মধ্যে স্কুল-কলেজের ভবন নির্মাণেই অনিয়ম প্রায় ৯০ কোটি টাকা, যা ঠিকাদারদের কাছ থেকে আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
এই অনিয়ম পেয়েছে বাংলাদেশ মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের অধীন শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর। নিরীক্ষায় মোট ৪৭ ধরনের অনিয়মের উল্লেখ করে আপত্তি দিয়েছে অধিদপ্তর। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে টাকা আদায়ের পাশাপাশি ঠিকাদারদের অর্থ পরিশোধের দায়দায়িত্ব নির্ধারণ করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশও করা হয়েছে।
জানতে চাইলে শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আমিমুল এহসান কবির আজকের পত্রিকাকে বলেন, অডিট আপত্তিগুলো সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে পাঠিয়ে এ বিষয়ে ব্রড শিটে জবাব চাওয়া হয়েছে। প্রয়োজনীয় দালিলিক প্রমাণ পেলে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে আপত্তিগুলো নিষ্পত্তি করা হবে। নাহলে পরবর্তী পদক্ষেপ (সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো) নেওয়া হবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগ বলেছে, দপ্তরগুলো অডিট আপত্তির জবাব দিচ্ছে। সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের বিভিন্ন দপ্তরের ২০২০-২১ অর্থবছরের ব্যয়ে শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর এসব অনিয়ম পেয়েছে। এর মধ্যে ‘গুরুতর আর্থিক অনিয়ম’ হয়েছে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের (ইইডি) বিভিন্ন কার্যালয়ের কাজে। ইইডি সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন, নতুন ভবন নির্মাণ, বিদ্যমান ভবনের সম্প্রসারণ ও রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামত, সংস্কার এবং আসবাব সরবরাহ করে। এ ছাড়া মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ও আইসিটি ল্যাব স্থাপন, ইন্টারনেট সংযোগ, আইসিটি-সুবিধা দেওয়ার কাজও করে।
নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইইডির অধীনে ২০২০-২১ অর্থবছরে যশোর, পটুয়াখালী, রংপুর, হবিগঞ্জ ও চাঁদপুরে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনাবাসিক ভবন নির্মাণ হয়েছে। ৮১ কোটি ৮৮ লাখ ৬৫ হাজার ৭০৬ টাকার এই কাজ হয়েছে ইইডির জেলা নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়ের মাধ্যমে। এসব ভবনের নির্মাণসামগ্রীর মান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) অথবা খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করার নির্দেশনা থাকলেও তা করা হয়নি। ঠিকাদারেরা নির্মাণসামগ্রীর মান পরীক্ষা করিয়েছেন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে। এটিকে গুরুতর আর্থিক অনিয়ম হিসেবে চিহ্নিত করে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে ঠিকাদারদের পরিশোধ করা অর্থ আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া ঠিকাদারকে অর্থ পরিশোধের দায়দায়িত্ব নির্ধারণ করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং পরিশোধ করা অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা দিয়ে অধিদপ্তরকে জানাতে বলা হয়েছে।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইইডির যশোর, খুলনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মৌলভীবাজার, সিলেট, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, নোয়াখালী, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ঝিনাইদহ, কুমিল্লা, টাঙ্গাইল, রাজশাহী, কুষ্টিয়া ও সুনামগঞ্জ জেলায় ভবন নির্মাণের অতিরিক্ত কাজের ক্ষেত্রে কোনো নিয়ম মানা হয়নি। অতিরিক্ত কাজের আগে অনুমোদন, নকশা পরিবর্তন ও অতিরিক্ত কাজের বিল পরিশোধের নির্দিষ্ট সময়সীমার বিধান এই ১৭ জেলায় লঙ্ঘন করা হয়েছে। এতে সরকারের ৮ কোটি ৭ লাখ ৯৫ হাজার ৬৫৪ টাকা ক্ষতি হয়েছে। এই অর্থও সরকারি কোষাগারে ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা হয়েছে।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে ভবনের ফাউন্ডেশনের সময় মাটি কেনার নামে ২৮ লাখ ৭৯ হাজার ২৩৮ টাকা ঠিকাদার পকেটে ঢুকিয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ, পুনরায় ভরাটের জন্য নতুন মাটি কেনার প্রয়োজনই পড়ে না। এই কাজও হয়েছে ইইডির অধীনে। নিরীক্ষায় বিষয়টিকে গুরুতর আর্থিক অনিয়ম উল্লেখ করে ওই টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
এসব অনিয়মের বিষয়ে ইইডির প্রধান প্রকৌশলী মো. দেলোয়ার হোসেন মজুমদার বলেন, ‘আমি গত অক্টোবরে দায়িত্ব নিয়েছি। এই অডিট আপত্তিগুলো এর আগের। অডিট আপত্তিগুলো নিষ্পত্তির বিষয়ে প্রধান কার্যালয়ের একজন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীকে প্রধান করে অডিট সেল গঠনসহ একাধিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। নির্মাণকাজের বাস্তবায়ন ও ব্যয় পরিশোধে যাতে অডিট আপত্তি না হয়, সে বিষয়েও কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’
শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ঠিকাদারের বিল থেকে লিকুইডেটেড ড্যামেজ কেটে না রাখায় ১৮ কোটি ৬ লাখ ৩ হাজার ১২২ টাকা এবং ভ্যাট না কাটায় ৩ কোটি ৫০ লাখ ১৭ হাজার ৩৫৯ টাকার আর্থিক অনিয়ম হয়েছে। প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ করা জমির মূল্য অনিয়মিত পরিশোধ করায় ২ কোটি ৩৩ লাখ ৩৭ হাজার ৯০ টাকা, বিধিবহির্ভূতভাবে অতিরিক্ত হারে ভাড়া ভাতা নেওয়ায় ৬৭ কোটি ৬৪ লাখ ৭৮ হাজার ২৭০ টাকা এবং চুক্তিমূল্য উপেক্ষা করে বেশি বিল পরিশোধ করে ২ কোটি ৭ লাখ ৬২ হাজার ৩১৫ টাকার আর্থিক ক্ষতি করা হয়েছে। এ ছাড়া বেশি দামে ছোট বেঞ্চ কিনে ২ কোটি ৫ লাখ ৩০ হাজার ৬০২ টাকার অনিয়ম হয়েছে। নির্মাণকাজের বিপরীতে বিমা পলিসি না খোলায় বিমা প্রিমিয়াম বাবদ আর্থিক ক্ষতি ২ কোটি ৯৫ লাখ ৬১ হাজার ৩৬৩ টাকা, গবেষণা বাবদ দেওয়া অগ্রিম সমন্বয় না করায় অনিয়মিত ব্যয় ২১ কোটি ৭৮ লাখ টাকা, ঠিকাদারকে একাধিক বিল পরিশোধ করায় ১ কোটি ৪৯ লাখ ১২ হাজার ৫৮ টাকা, রডের আয়তন বাদ না দিয়ে বিল পরিশোধ করায় ২ কোটি ৪০ লাখ ৯২ হাজার ৮০৫ টাকা, প্রাক্কলনের বেশি বিল পরিশোধ করায় ১ কোটি ৩২ লাখ ৭৮ হাজার ৮৮ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এর বাইরে আরও ৩৬টি খাতে বিভিন্ন অঙ্কের আর্থিক অনিয়ম উল্লেখ করা হয়েছে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, শুধু টাকা ফেরত নয়, এসব অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। জনগণের ট্যাক্সের টাকা যারা নয়-ছয় করেছে, তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।
শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের অডিট আপত্তির বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের যুগ্ম সচিব (নিরীক্ষা ও আইন) মূকেশ চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, অডিট আপত্তিগুলোর জবাব সংশ্লিষ্ট দপ্তর ব্রড শিটের মাধ্যমে দিচ্ছে। জবাবে সন্তুষ্ট হলে আপত্তিগুলো নিষ্পত্তি করা হচ্ছে। এটি চলমান প্রক্রিয়া। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে যেসব সুপারিশ করা হয়েছে, সে মোতাবেক ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
প্রকাশিত মঙ্গলবার ০৪ জুলাই ২০২৩